মুক্তমনা প্রকাশনার বলিষ্ঠ ও সাহসী লেখক অভিজিৎ রায় একজন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী নাগরিক। তিনি তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা এবং কন্যা তিশার সাথে দীর্ঘ ৭ বছর বা তার অধিক সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। কিন্তু মনেপ্রাণে তিনি নিজেকে বাঙ্গালী বলে গর্ববোধ করতেন। তিনি পারিবারিক পরিচয়সূত্রে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। বিদেশে থাকলেও তাঁর মন পড়ে থাকতো এদেশের জন্য। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যতই সুপ্রতিষ্ঠিত হোক, যতই তাঁর লেখালেখির জন্য খ্যাতি থাকুক, বাংলাদেশের প্রতি তিনি সবসময়ই মনের টান অনুভব করতেন। তিনি শুধু পরিবারের সদস্যদেরকেই নন, বাংলাদেশের অভাব মনেপ্রাণে বোধ করতেন। প্রথমে তাঁর সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরছি।

ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন খুবই চঞ্চল, আবেগী ও অস্থির প্রকৃতির। তবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মিশুক ও হাসিখুশি প্রকৃতির। খুব হাসি-ঠাট্টা প্রিয় ও খোলামেলা স্বভাবের। তবে মাঝে মাঝে সামান্য বিষয়েও রেগে যেতেন, কিন্তু তা মিলিয়ে যেতে কয়েক মুহুর্তও লাগত না। আমি আবার তার বিপরীত। ছোটবেলা থেকেই আমি আত্মকেন্দ্রিক, একাকীত্বপ্রিয় এবং কিছুটা চাপা প্রকৃতির। ফলে মাঝে মাঝেই আমার এই বৈশিষ্ট্য তিনি সহজভাবে নিতেন না। এ নিয়ে প্রায়ই আমার সাথে ঝগড়াঝাটি লাগত। ফলে আমার মন প্রায়ই খারাপ থাকত। সত্যি কথা বলতে কি, ছোটবেলায় আমাদের মধ্যে খুব একটা ঁহফবৎংঃধহফরহম ছিল না, কিছুটা মানসিক দূরত্বও ছিল। তবে তিনি যতই আমার সমালোচনা করুক, আমার ভাল দিকগুলো তুলে ধরতে কার্পণ্য করতেন না। আমার মধ্যে যদি সামান্য গুণও দেখতেন, তা যতই তুচ্ছ হোক, অবলীলায় তার প্রশংসা করতেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি অগোছালো প্রকৃতির, বহির্মুখী, বেপরোয়া, আড্ডাবাজ প্রকৃতির। আমি অবশ্য তাঁকে খাটো করার জন্য এসব বলছি না। কারণ, দোষে-গুণেই মানুষ। কিন্তু মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার একটা অসাধারণ গুণ তাঁর মধ্যে সন্দেহাতীতভাবেই ছিল। সোজাসাপটা কথার জন্য তিনি যেমন নিন্দিত, তেমনি নন্দিত। দেশে থাকতে তাঁর ভালবাসা তেমনভাবে বুঝতাম না। বরং তখন তাঁকে অহংকারী, জেদী ও আধিপত্যপ্রিয় বলেই আমার মনে হতো। মনে হতো, তিনি আমাকে বুঝতেন না। এটা নিয়ে আমার তীব্র অভিমান ছিল। তবে তা ছিল আমার বোঝার ভুল।

অভিজিৎ রায় শুধু যে খোলা মনের মানুষ তা নয়, তিনি ছিলেন পড়াশোনায় অসম্ভব মেধাবী। শুধু পড়াশোনাই কেন, তার গল্পের বই পড়ারও ছিল অদম্য নেশা। বন্ধু-বান্ধব, লাইব্রেরী থেকে কত ধরণের গল্প বই তিনি সংগ্রহ করতেন, তার হিসাব নেই। সত্যি কথা বলতে কি, তাঁর কাছ থেকেই আমি গল্পের বই পড়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। কিশোর থ্রিলার, কিশোর ক্লাসিক, ভৌতিক গল্প, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস, বিংশ শতাব্দীর লেখকদের মধ্য হতে ভারতীয় লেখকদের মধ্যে সত্যজিৎ রায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, প্রবীর ঘোষ কত যে নামকরা লেখকের বই তার সংগ্রহের তালিকায় ভরপুর ছিল, তার হিসাব নেই। গল্পের বই পড়ার গুণটি আমি তাঁর কাছ থেকেই অর্জন করেছি। বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে তিনি হুমায়ুন আহমেদ, তসলিমা নাসরিন, ইমদাদুল হক মিলন এসবের বই পড়তে তিনি খুব পছন্দ করতেন। তাছাড়া বিখ্যাত শিকারী জিম করবেট, কেনেথ এ-ারসনের বই পড়তেও তিনি আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছেন। হয়তো অদম্য বই পড়ার নেশা থেকেই অবচেতনভাবেই তাঁর লেখক হওয়ার বাসনা গড়ে উঠেছিল, যা তাকে আজকের পর্যায়ে উন্নীত করেছে।

আমার পড়ার দিকে ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত সচেতন। আমার মনে আছে, নবম শ্রেণি হতে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত তিনি উৎসাহভরেই আমাকে পড়া দেখিয়ে দিতেন এবং মাঝে মাঝে নোটও দিতেন। আমি ভালো ফলাফল করলে খুশিতে গদগদ থাকতেন। আবার পরীক্ষা খারাপ হলে তিনি খুবই কষ্ট পেতেন। তিনি যেমন আড্ডাবাজ ছিলেন, তেমনি ছিলেন নিশাচর। তিনি যখন বুয়েটের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র ছিলেন, তিনি রাত চারটা পর্যন্ত জেগে পড়াশোনা করতেন। পরের দিন অনেক সময় সকাল ৯টায় ঘুম থেকে উঠতেন। ক্রিকেট ছিল তাঁর প্রিয় খেলা। আজও তার কেনা শচীন তেল্ডুলকারের পোস্টার আমাদের দেওয়ালে টাঙ্গানো। শুধু শচীন তেল্ডুলকার কেন, ইমরান খান, ভিভিয়ান রিচার্ডস, আজহার উদ্দিন, সুনীল গাভাস্কার সহ কত খেলোয়ারের ছবি যে তিনি সংগ্রহ করতেন, তার হিসাব নেই, যদিও ছবিগুলোর অনেকগুলো হারিয়ে গিয়েছে। রাত জেগে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখাও ছিল তাঁর আরেকটি নেশা। এ নিয়ে মা-বাবার সাথে কম ঝগড়া হয়নি। বিভিন্ন রকমের কাজে ছিল তার যথেষ্ট আগ্রহ। এছাড়া রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, ভূপেন হাজারিকা, অনুপ জালোটা, ব্যা- সঙ্গীতের প্রচুর ক্যাসেট তিনি কিনতেন ও প্রতিদিনই গান শুনতেন।

তাঁর একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি খুব ভোজনরসিক ছিলেন। প্রায়ই মার কাছে এটা-ওটা খাওয়ার বায়না ধরতেন। বিদেশে থাকলেও তিনি বাংলাদেশের খাবারগুলো খুব মিস করতেন এবং দেশে যখনই আসতেন, প্রিয় প্রিয় খাবারগুলো বাসায় রান্না হতো, তার মন খুশীতে ভরে যেত।

দেশে থাকতেই তিনি অন্যায়, অবিচারের প্রতি প্রতিবাদমুখর ছিলেন। হুমায়ূন আজাদ, প্রবীর ঘোষ, তসলিমা নাসরিন, আরজ আলী মাতুব্বরের বইয়ের তিনি খুব একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তখন থেকেই তিনি নাস্তিক্যের ধ্যানধারণা গ্রহণ করতে লাগলেন এবং নাস্তিক্যবাদের যৌক্তিকতা অনুধাবন করলেন। তিনি ধর্মীয় উপাধিসূত্রে হিন্দু হলেও তিনি কখনো নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দিতে চাইতেন না। তিনি পূজা করা, পা ছুয়ে প্রণাম করা, শ্রাদ্ধ করা এসব লোকদেখানো আচার অনুষ্ঠান অত্যন্ত অপছন্দ করতেন। খাওয়ার ব্যাপারে ধর্মীয় বিধিনিষেধ তিনি মানতেন না। অত্যন্ত অবাধ্য ও বিদ্রোহী মনোভাবের ছিলেন। তাই বলে তিনি অসামাজিক ছিলেন, তা নয়। তিনি দেশে থাকতেই বলতেন, তিনি বাবা বা মা মারা গেলে শ্রাদ্ধ করবেন না, তাতে যে পরিণতিই ঘটুক। ছাত্র জীবনেই তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি অবিশ^াস শুরু হয়। শুধু ধর্মীয় ব্যাপারেই নয়, নারী-পুরুষকে কৃত্রিমভাবে বিভাজন করার সামাজিক রীতির ব্যাপারেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। আমার এখনো মনে আছে, বুয়েটে অনার্সে তিনি ফার্স্ট ক্লাস সেভেনথ হয়েছিলেন। শিক্ষকতা পেশার প্রতি তত আগ্রহী না হলেও তিনি বুয়েটের লেকচারার পদে নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ভাইভায় তার ফলাফল সবচেয়ে ভালো হয়েছে। তাঁর নিয়োগ প্রায় নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে লেকচারার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বুয়েটের একজন শিক্ষকের সাথে পূর্বের কোন একদিনের মতবিরোধের জের ধরে তাকে সে নিয়োগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমি পরে বিষয়টা জানতে পারি। একবার বুয়েটের ছাত্রছাত্রীদের জন্য এক শিক্ষা সফরের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু ছেলেদের জন্য কোন শিক্ষকের যাওয়ার প্রয়োজন না পড়লেও মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য একজন শিক্ষক পাঠানোর প্রসঙ্গ উঠেছিল। এই লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের দ্বিমুখী নীতি সবাই মেনে নিলেও তিনি তা মেনে নেননি এবং প্রতিবাদ করতেও কুণ্ঠিত হন নি। কিন্তু এটিই সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের Prestige Issue হয়ে দাঁড়ালো। সম্ভবত সে কারণে ভাইভা বোর্ডে ঐ শিক্ষক উপস্থিত থাকাতে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। মা তাঁকে ঐ শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করলেও তিনি তার কর্ণপাত করেন নি। তিনি বলতেন, অন্যায় মেনে নিয়ে তিনি এ চাকরি করতে পারবেন না। যাই হোক, তিনি শিল্পপতি সালমান এফ রহমান কর্তৃক পরিচালিত বেক্সিমকো কোম্পানীতে NIT এর উপর ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি করেছিলেন এবং যথারীতি প্রথম স্থান অধিকার করে আসছিলেন। অবশ্য ইতিপূর্বে অটোবী কোম্পানীতে তিনি আর্কিটেকচার পদে কয়েকমাস চাকরিও করেছিলেন। বুয়েটে স্কলার শিপ পাওয়ার পর তিনি সিঙ্গাপুরে এম.এস.সি. করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৯৮ সাল হতে তিনি সেখানে অবস্থান করলেন। যাওয়ার আগে মা খুব কান্নাকাটি করছিল। তিনি তখন বললেন, “মা, তুমি এরকম কান্নাকাটি করলে কিন্তু আমি সিঙ্গাপুরে গিয়ে আবার ফিরে আসবো।” এবং এয়ারপোর্টে যখন আমরা তাকে বিদায় দিতে গিয়েছিলাম, তখন তিনি বাবাকে বলেছেন, “অনুর দিকে খেয়াল রেখো।” (এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি, আমার ডাক নাম অনু)।