২০১৫ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি এস সি’র সামনে অভিজিত রায় ও তার স্ত্রী বন্যা আহমেদ নৃশংসভাবে আক্রান্ত হন। ঘাতকদের চাপাতির কোপে অভিজিত এবং বন্যা মাথাসহ শরীরের অন্যান্য জায়গায় গুরুতর আহত হন। বন্যা প্রাণে বেঁচে গেলেও ওর হাতের একটি আঙ্গুল কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই। অভিজিত প্রাণ হারান।

অভিজিত শুধু একজন বহুলপরিচিত লেখকই ছিলেন না, ছিলেন একজন অত্যন্ত প্রাণবন্ত মানুষ এবং একটি হৃদয়বান বাবা, স্বামী, ছেলে এবং বন্ধু। আমেরিকাপ্রবাসী অভিজিত ছিলেন একজন সক্রিয় ব্লগার এবং যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তক এবং নিরীশ্বরবাদীদের জন্য প্রথম বাংলা আন্তর্জালিক প্ল্যাটফর্ম ‘মুক্তমনা’র প্রতিষ্ঠাতা। তিনি শুধু বিজ্ঞান বা নাস্তিকতা নিয়েই লিখতেন না, তার লেখনী যে কোন ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যে কোন ধরনের অবিচার, কুসংস্কার অথবা বৈষম্যের প্রতিবাদে অত্যন্ত সোচ্চার ছিলো। তার লেখা বই ও ব্লগগুলোর বিষয়ের ব্যপ্তির দিকে তাকালেই ওপরের কথাটার প্রমাণ মেলে। নারীবাদ থেকে শুরু করে (হাইপেশিয়াকে নিয়ে মর্মস্পর্শী লেখাটা এক্ষেত্রে বিষেশভাবে উল্লেখ্য) সমকামিতা, কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা, অথবা ইরাক যুদ্ধে কি আবু ঘারীবে ঘটতে থাকা অমানবিকতা, গুজরাতের, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনের নিষ্ঠুর বাস্তবতা, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনীর উদাসীনতা – এসবই ছিলো তার লেখার বিষয়বস্তু।

অভিজিতের লেখা ও সম্পাদনা করা বইয়ের সংখ্যা দশ। প্রাণের উৎস, শূণ্য থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভব, সমকামিতার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আর্জেন্টিনিয় নারিবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’র মধ্যকার সম্পর্ক – এগুলো নিয়ে লেখা বই তাকে খ্যাতি এবং পরিচিতি এনে দিলেও, ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ ও ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ নামের বইদুটো অভিজিতকে একইসাথে জনপ্রিয়তার শীর্ষে এবং পাশাপাশি প্রচণ্ড ঝূঁকির মুখে নিয়ে যায়। ইসলামি মৌলবাদী দলগুলোর প্রবল বিরোধিতা এবং ক্রমবর্ধমান ক্রোধের চূড়ান্ত পরিণতি অভিজিতের ওপর হামলা এবং তার প্রাণনাশ।

কিন্তু, অভিজিতের হ্নদস্পন্দন থামানো গেলেও তার কলম, কিংবা কথা থামানোর এই প্রচেষ্টা সফল হয় নি। অভিজিত বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তিবাদ, এবং বাকস্বাধীনতার প্রতীক হয়ে রয়েছে। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে ঘাতকের হাতে প্রাণ হারালেও, অভিজিত আসলে তার কাজ, কথা এবং মতবাদের ভিত্তিতে অমর হয়ে থাকবে।

‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ নামের বইটাতে অভিজিতের নিজের সম্পর্কে বলে – “আমার কখনই লেখক হবার উচ্চাশা ছিলো না, কিন্তু মনের গভীরে একটা স্বপ্ন ছিলো। আমি পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলাম। মুক্তমনা’র সৃষ্টি হয় ঐ স্বপ্নের পথ ধরেই। ২০০১ সালে সমমানসিকতার কিছু লেখক/লেখিকাদের সাথে নিয়ে মুক্তমনা শুরু করা হয়। এখন মুক্তমনা সকল বাঙ্গালী বিজ্ঞান লেখক, যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদীদের একটি বিশ্বস্ত প্ল্যাটফর্ম। প্রথম থেকেই আমার লেখার মূল লক্ষ্য ছিলো সমসাময়িক বিজ্ঞান এবং দর্শনের নানা বিষয়। আমি আমার পাঠকদের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তারা আমার লেখা পড়েছেন, সমর্থন করেছেন। কেউ কেউ আমার লেখাকে অন্যরকম ভাবেন, কেউবা আবার অসাধারণ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বলে মনে করেন। আমি ঠিক এই বিশেষণগুলো নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নই। আমার বইএর পাঠ প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে দিয়েছে যে বাংলাদেশের মানুষ বিজ্ঞান এবং দর্শনের ওপর বই পড়তে আগ্রহী। এটাই ছিলো আমার লেখালেখির মূল উদ্দেশ্য। আমি পেশায় একজন প্রকৌশলী। বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে আমি সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে পি এইচ ডি করি। এখন আমেরিকাতে একজন কম্পিউটার আর্কিটেক্ট হিসেবে কাজ করছি। অবসর সময়ে বই পড়ি, গান শুনি, লিখি এবং নিয়মিতভাবে আমার স্ত্রী বন্যার বকা খাই। এবং সবসময়ই, সবকিছুর মধ্যেও, আরও কিছু শেখার, চিন্তা ও মননকে আরও আলোকিত করার চেষ্টায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখি।”